অ্যাজমা

সারাংশ

শ্বাস নালী (ব্রংকাই) সরু হয়ে যাওয়ার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধার নাম হাঁপানি। এটি একটি দীর্ঘ স্থায়ী বংশানুক্রমিক অসুখ। এই রোগে দেহে বাতাস প্রবেশের রাস্তা বিভিন্ন বস্তুর প্রতি সংবেদনশীল হয়, যেমন ফুলের পরাগ, মোল্ড, আরশোলার মল, ধুলোর কীট, বিড়াল বা কুকুরের লোম, সংক্রমণ এবং অন্যান্য বিরক্তিকর বস্তু (পরিবেশের দূষণ, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, ব্যায়াম, ওষুধের মধ্যে এসপিরিন, কৃত্রিম সংরক্ষক)। এই এলার্জিকারী বস্তুগুলির (এলার্জেন) সংস্পর্শে এলে শ্বাস নালী সংকুচিত হয়। এর ফলে দমবন্ধ, কাশী, বুকের উপরে চাপ এবং বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দের মত উপসর্গগুলি দেখা যায়।

বাচ্চাদের মধ্যেও হাঁপানি একটি সাধারণ অসুখ। এই বাচ্চারা ঘরের ভিতরের এলার্জেনগুলির (বিছানার ধুলো, কারপেট, পরাগ রেণু, পোষা জন্তু) প্রতি সংবেদনশীল হয়। এর ফলে প্রায়ই তাদের অসুখে ভুগতে হয়। যেহেতু হাঁপানির কোন নিরাময় নেই, তাই তাৎক্ষণিক আরাম দেওয়া এবং বারে বারে এর আক্রমণ বন্ধ করাই চিকিৎসার লক্ষ্য হয়। হাঁপানির চিকিৎসায় শ্বাসের সাথে নেওয়ার স্টেরয়েডস, ব্রঙ্কোডায়ালেটারস (শ্বাস নালীর পেশীগুলি শিথিল করে বাতাস যাওয়ার পথ করে দেয় যে ওষুধগুলি) এবং ফোলা বন্ধ করার ওষুধগুলি সাধারণত প্রেসক্রাইব করা হয়। অধিকন্তু, নিজের যত্ন নেওয়া যেমন কোন বস্তুগুলি থেকে হাঁপানি হয় তা জানা এবং এড়িয়ে চলা, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে রাখা এবং নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা বিশেষ ভাবে হাঁপানির সাথে লড়াইতে সাহায্য করে।

উপসর্গ

● ঊর্ধ্বশ্বাস অথবা নিঃশ্বাসের দুর্বলতা
● বুকের ভিতর শোঁ শোঁ আওয়াজ
● কাশি হয়
● দম বন্ধ হয়ে আসা

চিকিৎসা

চিকিৎসার উদ্দেশ্য হল রোগের তীব্র আক্রমণ থেকে তাৎক্ষনিক মুক্তি এবং ভবিষ্যতে দীর্ঘ সময় ধরে রোগের গুরুতর আক্রমণকে প্রতিহত করা।

দ্রুত ত্রাণ (ত্রাণদায়ী ওষুধ)

এইগুলিকে উদ্ধারকারী ওষুধ বলা হয়। হাঁপানির তীব্র কষ্টদায়ক আক্রমণ থেকে তাৎক্ষণিক আরাম পাওয়ার জন্য এইগুলির ব্যবহার করা হয়। ব্যায়াম শুরু করার আগে এই ওষুধগুলি সেবন করার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা কারণ সাধারণত ব্যায়াম করার পর হাঁপানির টান শুরু হয়ে যায় (ব্যায়াম-প্ররোচিত হাঁপানি)। ব্যায়ামগুলির উদাহরণ হল দৌড়ানো বা শীতকালীন ক্রীড়া (স্কিইং, আইস স্কেটিং, আইস হকি)। দ্রুত-মুক্তিদায়ী ওষুধগুলি মসৃণ পেশীগুলিকে শিথিল করে দিয়ে সংকুচিত বায়ুচলাচলকারী নলিকে খুলে দেয় যাতে বাতাস চলাচলে কোন বাধা না আসে। হাঁপানির তীব্র এবং কষ্টদায়ক উপসর্গগুলি থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে ত্রাণদায়ী ওষুধগুলির মধ্যে প্রথম পছন্দ হল দ্রুত কার্যকারী বিটা-অ্যাগোনিস্টগুলি। এইগুলি হল শ্বাসের সাথে মুখ ভিতরে টেনে নেওয়ার ওষুধ, যা প্রয়োগ মাত্রই শ্বাস নালীকে দ্রুত শিথিল করে দেয় (ব্রঙ্কোডায়ালেশান)। ডাক্তাররা যে ওষুধগুলি প্রেসক্রাইব করেন সেগুলি হল অলবিউটেরল, লেভালবিউটেরল এবং পিরবিউটেরল।

যখন আপনি এই ত্রাণকারী ওষুধগুলি নিচ্ছেন, তখনও দীর্ঘ সময় ধরে হাঁপানির যে ওষুধগুলি আপনি ব্যবহার করেন সেগুলি বন্ধ করবেন না। যদি আপনাকে সপ্তাহে দুই বারের অধিক এই ত্রাণকারী ওষুধগুলি ব্যবহার করতে হয় তাহলে তা ডাক্তারকে জানান জরুরী।


দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ (নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ)


ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েডস হাঁপানির দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসার জন্য এইগুলি প্রথম পছন্দ। এর ব্যবহারে শ্বাস নালীর প্রদাহ কমে, ফলে শ্বাস নালীর ফোলাও কমে যায় (যেমন ফ্লুটিকাজোন, বাডেসোনাইড, মোমেটাজোন, বিক্লোমিথাজোন এবং প্রেডনিজোলন)।

ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েডস এবং দীর্ঘ সময় কার্যকরী বিটা-অ্যাগনিস্টস  দীর্ঘ সময় কার্যকরী বিটা-অ্যাগনিস্টস (এল-এ-বি-এ) মসৃণ পেশীগুলিকে শিথিল করে রাখে এবং শ্বাস নালীকে  খুলে রাখে। রাত্রি-কালীন হাঁপানি এবং ব্যায়াম প্ররোচিত হাঁপানির চিকিৎসার জন্য কখনও কখনও এই ওষুধগুলি ব্যবহার করা হয়। অবশ্য হাঁপানির দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা এল-এ-বি-এ'র সাথে সব সময়েই ইনহেলড স্টেরয়েডস দিয়ে থাকেন। এই সমন্বয় এছাড়াও ব্যবহার করা হয় যখন দ্রুত কার্যকারী বিটা-অ্যাগোনিস্ট এবং ইনহেলড স্টেরয়েডস একটি তীব্র আক্রমণের উপসর্গ উপশম করতে ব্যর্থ হয়। এই সমন্বয়ের উদাহরণ হল ফ্লুটিকাজোন ও সালমেটেরল, ফ্লুটিকাজোন ও ভিলানটেরল এবং বাডেজোনাইড ও ফরমোটেরল।

দীর্ঘকাল-কার্যকারী এন্টিকোলিনারজিকস এগুলি শ্বাসের সাথে ভিতরে টেনে নেওয়ার ওষুধ। এগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণকারী ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয় যাতে শ্বাস নালীর মসৃণ পেশীগুলি সব সময়ই শিথিল থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে টিওট্রোপিয়াম এবং ইপ্রাট্রোপিয়াম। ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ডাক্তাররা অনেক সময় দুইটি এন্টিকোলিনারজিক ওষুধের সমন্বয় ব্যবহার করেন।

মিথাইলজ্যানথিনস মিথাইলজ্যানথিনগুলি, যেমন থিয়োফাইলিন, রাত্রি-কালীন হাঁপানির প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়।

লিউকোট্রাইন রিসেপটার এন্টাগনিস্ট অথবা লিউকোট্রাইন মডিফায়ার্স এই ওষুধগুলি খেলে শ্বাস নালীতে ব্রঙ্কোস্প্যাজম, প্রদাহ এবং ফোলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আছে মন্টেলুকাস্ট এবং জাফিরলুকাস্ট।

মাস্ট-সেল স্থিতিশীলকারক এগুলি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে; ফলে ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে বা ব্যায়াম করার জন্য যে তীব্র হাঁপানি হয়  তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় (উদাহরণ: ক্রোমোলিন সোডিয়াম)।

ইমিউনোথেরাপি অথবা ইমিউনোমডিউলেটারস এই ওষুধগুলি ইনজেকশানের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। পরাগ রেণু, মোল্ডস, ধুলোর কীট এবং পশুর ড্যান্ডা্‌রের মত বিভিন্ন এলার্জেনের সংস্পর্শে এলে যে হাঁপানি হয়, তা প্রতিরোধ করতে এই ওষুধগুলি ব্যবহার করা হয়। ওমালিজুমাব'এ রয়েছে এন্টি-আই-জিই মোনোক্লোনাল এন্টিবডিজ, যা এলার্জেনের বিরুদ্ধে দেহের এলার্জি প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য উদাহরণগুলি হচ্ছে রেসলিজুমাব এবং বেনরালীজূমাব।

ব্রঙ্কিয়াল থার্মোপ্লাস্টি যে প্রাপ্তবয়স্ক গুরুতর হাঁপানির রোগীরা চিকিৎসা থেকে উপকৃত হন না তাদের জন্য এটি একটি সাম্প্রতিক এফ-ডি-এ দ্বারা অনুমোদিত পদ্ধতি। শ্বাস নালীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে তাপ শক্তি উৎপন্ন করে বায়ুচলাচলকারী মসৃণ পেশীগুলি ধ্বংস করা হয়। মসৃণ পেশীগুলি ধ্বংস হওয়ায় শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সেই কারণে শ্বাস নালীর সংকোচন হ্রাস হয়।

লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট

● নিজের যত্ন নিজে নেওয়া
● রোগটি সম্বন্ধে পর্যাপ্ত ভাবে বোঝা এবং এলার্জেনগুলি সম্পর্কে তথ্য থাকা
● ওষুধ ব্যবহারের ফ্লো-চার্ট থাকা
● দুশ্চিন্তা না করা
● শ্বাসের ব্যায়াম, ধ্যান, যোগব্যায়াম, এবং অন্যান্য মন শিথিল করার কৌশলগুলি হাঁপানি সংক্রান্ত ভয় ও দুশ্চিন্তা কাটিয়ে ওঠার দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে
● নিয়মিত হাল্কা ব্যায়াম করা যেমন হাঁটা, ধূমপান পরিত্যাগ করা এবং পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসের মতন জীবনধারার কয়েকটি পরিবর্তন হাঁপানির ব্যবস্থাপনায় যোগ করা যেতে পারে

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক