পিঠে ব্যথা

সারাংশ

ঘন ঘন ডাক্তার দেখানোর জন্য দায়ী অত্যন্ত প্রচলিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির অন্যতম হল পিঠে ব্যথা। পিঠে ব্যথা তীব্র (কয়েকদিন বা সপ্তাহের জন্য স্থায়ী) কিংবা দীর্ঘস্থায়ী (3 মাস বা তার বেশি স্থায়ী) হতে পারে। এর অবস্থিতির উপর নির্ভর করে, পিঠে ব্যথা ঢিমে বা তীক্ষ্ণ হতে পারে, খুব দ্রুতবেগে এবং থেমে থেমে, অথবা অবিরত। যদি ব্যথাটা পা বা কুঁচকিতে যন্ত্রণাদায়ক খচখচানি এবং/অথবা অসাড়তা, নিয়ন্ত্রিত চলাফেরার সাথে শক্তভাব কিংবা প্রস্রাব বা মলত্যাগে নিয়ন্ত্রণ হারানোর সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, অবিলম্বে চিকিৎসাগত পরিচর্যা দরকার।

অল্প পিঠে ব্যথার প্রচলিত কারণগুলির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে পেশীর খিঁচুনি, আঘাত, স্লিপড বা হার্নিয়েটেড ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক (মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধির মধ্যে কোনও হাড় সেটার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে আশেপাশের কোনও নার্ভ বা স্নায়ুর উপর চাপ দিলে যে ব্যথার কারণ ঘটায়), মেরুদণ্ডের অস্থিভঙ্গ, সায়াটিকা বা স্নায়ুর মূলদেশ সংকোচন, বয়সের কারণে আর্থ্রাইটিস (গাঁটের বাত), অস্টিওপোরোসিস (হরমোনগত পরিবর্তন অথবা ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ডি-এর অভাবজনিত কারণে হাড় দুর্বল এবং পলকা হয়ে যাওয়া), অটোইমিউন ডিজঅর্ডার (অ্যাংকিলুজিং স্পন্ডিলাইটিস – একটা প্রদাহী বা জ্বালা ধরানো বাত যা মেরুদণ্ড এবং বড় গ্রন্থিগুলিকে আক্রমণ করে), স্পাইন্যাল স্টেনোসিস (মেরুদণ্ডগত কোন দেহনালীর সংকীর্ণ অবস্থা), মেরুদণ্ডের বিকৃতি এবং, ক্যান্সার। কখনও কখনও, মানসিক চাপও অল্প পিঠের ব্যথার কারণ ঘটায় বলে জানা যায়, যা প্রায়শই অবহেলা করা হয়ে থাকে। অল্প পিঠের ব্যথা কোন কোন সময় রেফার্ড পেইন (ব্যথার প্রকৃত উৎসস্থলের বদলে শরীরের অন্য জায়গায় ব্যথা অনুভব করা) হিসাবে হাজির হয় যার উৎসস্থল বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে থাকে, যেমন কিডনিগুলি (উদাহরণঃ রেনাল ক্যালকুলাস, টিউমার), জরায়ু (উদাহরণঃ ফাইব্রয়েড, মাসিকের ব্যথা এবং, গর্ভাবস্থা)।

কোনও অন্তর্নিহিত মেডিক্যাল সমস্যা ছাড়া তীব্র পিঠে ব্যথা সচরাচর বিশ্রাম এবং ওষুধের সাহায্যে ভাল হতে থাকে। চলাফেরায় হঠাৎ সমস্যাসহ তীব্র ব্যথা, বিশেষতঃ কোনও অস্থিভঙ্গ অথবা স্লিপড ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক-এর (মেরুদণ্ডের ভিতরের কোনও হাড় সরে যাওয়া) পর জরুরি অস্ত্রোপচার, তারপর সাধারণ চিকিৎসার (অস্ত্রোপচারহীন চিকিৎসা) প্রয়োজন হয়। দীর্ঘস্থায়ী পিঠে ব্যথার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনার দরকার হতে পারে যার মধ্যে রয়েছে ওষুধ, ফিজিওথেরাপি এবং, নির্দিষ্ট কতগুলি ব্যায়াম।

উপসর্গ

● বসা, শুয়ে থাকা, ওজন তোলা, বা ঝুঁকে পড়লে ব্যথা আরও খারাপের দিকে যাওয়া।
● পা, নিতম্বের দিকে পিঠের ব্যথা ছড়িয়ে পড়া। 
● পা অথবা কুঁচকিগুলিতে খচখচানি এবং অসাড়তা সহ ব্যথা।
● প্রস্রাব এবং মলত্যাগে নিয়ন্ত্রণ হারানোসহ ব্যথা।
● বসা, দাঁড়ানো, অথবা চলাফেরার সময় প্রচণ্ড শক্তভাবের সাথে অস্বস্তির কারণ ঘটানো ব্যথা। 
● পিঠের দিক থেকে প্রস্রাবের থলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া ব্যথা সাথে ঘন ঘন প্রস্রাব করার তাড়না।
● জ্বর এবং বমির সাথে যুক্ত প্রচণ্ড পেটের ব্যথাসহ পিঠে ব্যথা। 
● পেটের ফুলে ওঠা কখনও কখনও পিঠে ব্যথার কারণ ঘটায়।
● টিউমারগুলি অল্প পিঠে ব্যথার কারণ ঘটায় যা পেটের উপর শুয়ে থাকলে বাড়ে এবং অবসাদ এবং ওজন কম হওয়ার সাথে যুক্ত।

চিকিৎসা

পিঠে ব্যথার চিকিৎসাকে সাধারণতঃ তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। পিঠের ব্যথার সাথে ব্যথা এবং উপসর্গগুলির প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ডাক্তার চিকিৎসা স্থির করেন। 

ওষুধহীন চিকিৎসা

সাধারণভাবে তীব্র এবং অনির্দিষ্ট পিঠের ব্যথা বিশ্রাম এবং স্ব-পরিচর্যাতেই ভাল হতে থাকে। পিঠে ব্যথার কিছু স্ব-পরিচর্যা পদ্ধতির মধ্যে নীচে উল্লিখিতগুলি আছেঃ 

গরম সেঁক এবং ম্যাসাজ (অঙ্গ সংবাহন)
এটা রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং পেশীর শক্তভাব শিথিল করে।

ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম এবং ট্র্যাকশন
এগুলি ফিজিওথেরাপিস্টদের তত্ত্বাবধানে করা উচিত। এগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যথা কমানোয় সাহায্য করে।

বৈকল্পিক থেরাপি
এগুলির মধ্যে আছেঃ যোগ (ব্যায়াম), যার সাথে জড়িত বিভিন্ন ধরণের প্রসারণ (শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ ছড়ানো) ব্যায়াম এবং অবস্থান যা পেশীগুলির শক্তভাব শিথিল করে। অ্যাকুপাংচার চিকিৎসায় আছে ব্যথা উপশম করার জন্য শরীরের নির্দিষ্ট বিন্দুগুলিতে সূঁচ ফোটানোর ব্যবহার।  কায়রোপ্র্যাক্টিক চিকিৎসায় দরকার হয় মেরুদণ্ডের মধ্যে অবস্থিত জোড় বা গাঁটগুলিতে শক্তভাব দূর করতে এবং নমনীয়তা নিয়ে আসার জন্য মেরুদণ্ডীয় অঙ্গগুলির উপর নিয়ন্ত্রিত শক্তিপ্রয়োগ দ্বারা মেরুদণ্ডে দক্ষতাসহকারে হস্তচালনা কৌশল।   মন শান্ত করার কৌশল, যেমন ধ্যান, বায়োফিডব্যাক, এবং আচরণে কিছু পরিবর্তন করার কৌশল, ব্যথা উপশম করতেও সাহায্য করে। 



মেডিক্যাল চিকিৎসা

দীর্ঘস্থায়ী পিঠের ব্যথা সামলানোয় ওষুধ একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠে যখন ওষুধহীন চিকিৎসার ব্যবস্থাগুলি ব্যথা উপশম করতে ব্যর্থ হয়। প্রচলিতভাবে বিধান দেওয়া ওষুধগুলির মধ্যে আছেঃ 

প্যারাসিটামল অথবা অ্যাসিট্যামাইনোফেন
এই ওষুধটা সাধারণতঃ পিঠের ব্যথার জন্য বিধান দেওয়া প্রথম ওষুধ। এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম থাকে।

নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটোরি ড্রাগস (এনএসএআইডিএস): এগুলি ব্যথা উপশমকারী এবং এর মধ্যে আছে আইবুপ্রোফেন এবং নেপ্রক্সেন।
যখন প্যারাসিটামল ব্যথা উপশম করতে পারেনা তখন এগুলির বিধান দেওয়া হয়। ব্যথা উপশমকারী ওষুধগুলি (পেইনকিলার্স) শরীরের কোনও অংশে লাগানোর ক্রিম, মলম এবং স্প্রে হিসাবেও লভ্য যেগুলি ব্যথার তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে। 

পেশী শিথিলকারী
ডাক্তাররা পেশীগুলির শক্তভাব কমাবার জন্য এনএসএআইডিএস-এর সাথে সাইক্লোবেঞ্জাপ্রিন এবং মেথোকার্বামল-এর মত পেশী শিথিলকারী ওষুধের পরামর্শ দেন। 

চেতনানাশক মাদকের মত ওষুধ  
ট্রামাডোল এবং মরফিন তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি দেবার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি একটা অল্প সময় (2-3 সপ্তাহ) ধরে ব্যবহারের জন্য বিধান দেওয়া হয়। ঘুম ঘুম ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য (পায়খানা শক্ত হওয়া), মুখের শুকনোভাব, ধীরে শ্বাস নেওয়া, এবং ত্বকের চুলকানির মত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে, এগুলি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়না।

অবসাদরোধী ওষুধ  
প্রধানতঃ ক্রনিক পিঠের ব্যথায় এবং তাঁদের জন্য যাঁরা দীর্ঘ-স্থায়ী ব্যথার কারণে অবসাদগ্রস্ত থাকেন, এগুলি ব্যবহার করা হয়। এগুলির মধ্যে আছে অ্যামিট্রিপটিলিন, ডুলক্সিটিন, এবং ইমিপ্র্যামাইন। যেহেতু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি  (উদাহরণস্বরূপ, ঝাপসা দৃষ্টি, ওজন বাড়া, এবং ঘুম ঘুম ভাব) খুব বেশি দেখা যায়, এই ওষুধগুলি কঠোর মেডিক্যাল তত্ত্বাবধানে নেওয়া উচিত।  

স্টেরয়েডস
কর্টিকোস্টেরয়েডস, যেমন প্রেডনিসোলোন, পায়ের নীচের দিকে বিকীর্ণ হওয়া ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। এগুলি আঘাতের স্থানে প্রদাহ (জ্বলন) এবং ফোলাভাব যেগুলি পিঠে ব্যথার কারণ ঘটায়, সেগুলিও কমায়। 

খিঁচুনি বা তড়কা-প্রতিরোধী
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি দেখিয়েছে যে পেইনকিলারের সাথে মৃগীরোগসম্পর্কিত-প্রতিরোধী ওষুধগুলি স্নায়ু-ব্যথার উপশমে কার্যকর, বিশেষতঃ ক্রনিক পিঠের ব্যথায়। কার্বাম্যাজুপাইন, গ্যাবাপেন্টিন, এবং ভ্যালপ্রোয়িক অ্যাসিড হচ্ছে প্রচলিতভাবে ব্যবহৃত মৃগীরোগ-প্রতিরোধী ওষুধ। বিভ্রান্তি, গ্যাস্ট্রিকের (পেটের) গোলমাল, এবং মাথাধরা হল তড়কা-প্রতিরোধী ওষুধগুলির দ্বারা ঘটিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
   


অস্ত্রোপচার

যখন অস্ত্রোপচার-হীন চিকিৎসা ব্যথা কমাতে পারেনা ডাক্তাররা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। বিকিরণকারী স্নায়ু ব্যথা, পেশীগুলিতে বর্ধিত দুর্বলতা, মেরুদণ্ডে বিকৃতি (স্পাইন্যাল স্টেনোসিস), মেরুদণ্ডের মধ্যেকার কোন ডিস্ক-এ চিড় ধরা, যেগুলি ওষুধ বা ওষুধ-হীন চিকিৎসার দ্বারা সফলভাবে নিরাময় করা যায়নি সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার। জরুরি পরিস্থিতিতেও অস্ত্রোপচার করা হয়, যেমন অস্থিভঙ্গ (হাড় ভাঙা) এবং কওডা ইকুয়িনা সিনড্রোম, যা পিঠের ব্যথার সাথে পক্ষাঘাত (শরীরে অসাড়তা) ঘটাতে পারে। 

স্পাইন্যাল ফিউশন হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া যেখানে মেরুদণ্ডগত প্রত্যঙ্গগুলিকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে দেওয়া বা সংযুক্ত করা হয়, যার দ্বারা সেগুলির মধ্যে কোনও নড়াচড়া না করা নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়া মেরুদণ্ডের প্রত্যঙ্গগুলিতে জোড় বা গাঁটের ব্যথার  (আর্থ্রাইটিস) উপশমের ক্ষেত্রে সহায়ক এবং শরীরের নড়াচড়া অনেক কম বেদনাদায়ক এবং স্বচ্ছন্দ (অবাধ) করে।

ল্যামিনেক্টোমি হচ্ছে একটা অস্ত্রোপচারমূলক প্রক্রিয়া যাতে সার্জন (অস্ত্র বা শল্য চিকিৎসক) মেরুদণ্ডীয় হাড় বা লিগামেন্ট-এর অংশ যা স্নায়ুর উপর চাপের কারণ হচ্ছিল, বার করে দেন। এই প্রক্রিয়া সাধারণভাবে স্পাইন্যাল স্টেনোসিস-এর ক্ষেত্রে করা হয় যেখানে স্পাইন্যাল ক্যানাল সংকীর্ণ হয়ে আসছে, যা পিঠের ব্যথার কারণ ঘটায়। 

ফোরামিনোটোমি মেরুদণ্ডের কাণ্ড (কর্ড) থেকে স্নায়ুগুলির বাইরে যাওয়ার পথের জায়গা বাড়াবার জন্য স্পাইন্যাল ক্যানাল চওড়া করার সঙ্গে যুক্ত।  

লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট

● কোনও ডিসেক্টোমিতে, সার্জন ডিস্ক-এর সম্পূর্ণ বা কিছু অংশ যা এর মূল অবস্থান থেকে অস্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এসেছে অথবা সরে গিয়েছে, বাদ দিয়ে দেন। এটা বেরিয়ে আসা ডিস্ক দ্বারা স্নায়ুগুলির উপর প্রযুক্ত চাপ থেকে মুক্তি দেয়।  
● যদিও প্রতিটি প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি থাকে, সামগ্রিক প্রভাব হল ব্যথার উপশম, চলাফেরায় স্বাধীনতা, ওষুধের প্রয়োজন কম হওয়া, এবং কাজের উৎপাদনে বৃদ্ধি। অস্ত্রোপচারের বিকল্প সার্জনের সাথে খুঁটিনাটি আলোচনা করার পর স্থির করা উচিত। পিঠের ব্যথায় জীবনধারা সামলানো
● পিঠের ব্যথার ফের সক্রিয়তা এড়ান
● সারাদিন ধরে সক্রিয় থাকুন  
● একটা স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর ডায়েট রাখুন
● ধূমপান  ছাড়ুন
● আপনার দেহভঙ্গিমা উন্নত করুন

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক